কাল বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ
সৃষ্টি হবে অপরূপ স্বর্ণবলয়
আগামীকাল দুপুরে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে দাঁড়ালে আকাশে দেখবেন একটা অপরূপ স্বর্ণবলয় বা গোল্ডেন রিং। মাঝখানটি কালো আর চারপাশে সোনালি আভা। কালো অংশটি হলো চাঁদ। চারপাশে সোনালি আভাটি হলো সূর্যের প্রান্ত অংশ। এটিই হলো সূর্যের বলয়গ্রহণ। দুপুরে এক মায়াবী আলো কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন অঞ্চলকে ঘিরে রাখবে
৮ মিনিটের অধিক সময়। বলয়গ্রহণের সময় তাপমাত্রাও কমে যাবে।
সারাদেশের মানুষ তাই ছুটে যেতে চাইছে কক্সবাজারের দিকে। ২০০৯ সালের ২২ জুলাই পঞ্চগড়ের অভিজ্ঞতা মানুষ ভুলে যায়নি। জাতিসংঘের ঘোষিত জ্যোতির্বিজ্ঞানবর্ষকে মনে রেখে দেশের মানুষ সাড়া দিয়েছিল। পঞ্চগড়েই লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল। সেটি ছিল বাংলাদেশ থেকে দেখা শতাব্দীর একমাত্র পূর্ণ সূর্যগ্রহণ। আর এবারের এ বলয় সূর্যগ্রহণও দেখা যাবে আরও প্রায় ৫৪ বছর পর অর্থাৎ ২০৬৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি।
বলয়গ্রহণের দৃশ্যটি পূর্ণগ্রহণ থেকে কিছুটা আলাদা। পূর্ণগ্রহণের সময় চাঁদ সূর্যকে সম্পূর্ণভাবে ঢেকে ফেলে; কিন্তু বলয়গ্রহণে চাঁদ সম্পূর্ণভাবে সূর্যকে ঢাকতে পারে না, চাঁদের চারপাশ দিয়ে চিকন ফালির মতো করে সূর্যের প্রান্ত অংশটি স্পষ্টভাবে দেখা দেয়। পূর্ণগ্রহণ আর বলয়গ্রহণের এ পার্থক্য মূলত সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে চাঁদের দূরত্বের হেরফেরের কারণে হয়ে থাকে। পৃথিবী থেকে বেশি দূরত্বে থাকলে বলয়, আর কাছে থাকলে পূর্ণগ্রহণ। প্রতি বছরই বিশ্বের কোথাও না কোথাও কমপক্ষে দুই থেকে পাঁচটি গ্রহণ দেখা যায়। সাধারণত পূর্ণগ্রহণের তুলনায় বলয়গ্রহণ বেশি দেখা যায়। কারণ গড়পড়তা চাঁদ বেশিরভাগ সময়ই পৃথিবী থেকে বহু দূরে অবস্থান করায় সূর্যকে সম্পূর্ণভাবে ঢাকতে পারে না। সাধারণত গড়ে একশ' বছরের মধ্যে শতকরা ২৮ ভাগ পূর্ণগ্রহণ, ৩৩ ভাগ বলয়গ্রহণ এবং বাকি আংশিক গ্রহণ পৃথিবী থেকে দেখা যায়।
পৃথিবীতে গ্রহণ শুরু হবে বাংলাদেশ সময় ১০টা ৫ মিনিট ২৭ সেকেন্ডে, আর গ্রহণ শেষ হবে বিকেল ৪টা ৭ মিনিট ৩৫ সেকেন্ডে। তবে বাংলাদেশে গ্রহণ শুরু বা চাঁদ পৃথিবীকে স্পর্শ করার সময় হচ্ছে দুপুর ১২টা ৪৪ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে, সর্বোচ্চ গ্রহণ হবে ২টা ৩২ মিনিট ২৫ সেকেন্ডে আর গ্রহণ শেষ হবে অর্থাৎ চাঁদ সূর্য থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক হবে বিকেল ৪টা ০১ মিনিট ৩২ সেকেন্ডে। দেশের বিভিন্ন এলাকা বিশেষে এ সময়ের কয়েক সেকেন্ড তারতম্য হতে পারে। বলয়গ্রহণ হওয়ার কারণে গ্রহণের ছায়াটি বেশ দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর ওপর বিরাজ করবে, যা পৃথিবীর অর্ধেক অংশকে চাঁদের প্রচ্ছায়া ও উপচ্ছায়া দিয়ে আবৃত করে রাখবে। এ বলয় সূর্যগ্রহণের মূল রেখাটি মধ্য আফ্রিকার শাদ থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো, উগান্ডা, কেনিয়া, ভারত মহাসাগর, কেরালা, তামিলনাড়ু, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপের কিছুটা দক্ষিণ হয়ে মিয়ানমারের আকিয়াবের ওপর দিয়ে গিয়ে চীনে শেষ হবে। এর গ্রহণের মধ্যরেখা অর্থাৎ চাঁদের প্রচ্ছায়ার প্রস্থ হবে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার এবং এর সর্বোচ্চ গ্রহণটি দেখা যাবে মধ্য ভারত মহাসাগরের দ্বীপাঞ্চল থেকে। প্রায় ১১ মিনিট ৮ সেকেন্ড সময়ব্যাপী এ বলয়গ্রহণের ছায়া পৃথিবীর বুকে অবস্থান করবে। গ্রহণের সময় চাঁদের উপচ্ছায়াটি উত্তরে আফ্রিকার উত্তরাংশ, পূর্বে ইউরোপ, এশিয়া (রাশিয়া থেকে চীনের সীমানা, একেবারে উত্তর মেরু এলাকা পর্যন্ত) এবং দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত মহাসাগর হয়ে ইন্দোনেশিয়ার ওপর দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমের কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে।
সবচেয়ে ভালো পর্যবেক্ষণ অঞ্চল : বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে ভালোভাবে সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করা যাবে সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, কক্সবাজার থেকে। এই বলয়গ্রহণে সেন্ট মার্টিন থেকে চাঁদকে সূর্যের বলয়ে অবস্থান করতে দেখা যাবে প্রায় ৮ মিনিট ২৩ সেকেন্ড পর্যন্ত এবং তা সূর্যের প্রায় ৮৩.৬৩ ভাগ অংশ ঢেকে ফেলবে। অবশ্য এ দ্বীপেরই দক্ষিণের একটি অংশ ছেঁড়াদ্বীপ ভূখণ্ডে বলয়গ্রহণের স্থায়িত্ব হবে ৮ মিনিট ২৯ সেকেন্ড। এটিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গ্রহণ সময়।
ঢাকা থেকে যদিও বলয়গ্রহণটি দেখা যাবে না, তবে গ্রহণটিকে আংশিক সূর্যগ্রহণ হিসেবে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার অধিবাসীরা পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। ঢাকা থেকে গ্রহণ শুরু হবে ১২টা ৪৩ মিনিট ৫৯ সেকেন্ডে, সর্বোচ্চ গ্রহণ হবে ২টা ৩১ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে এবং গ্রহণ শেষ হবে বিকেল ৪টা ০ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডে, ঢাকা থেকে এ গ্রহণটির প্রায় ৭৭.১ ভাগ দেখা যাবে।
বাংলাদেশ থেকে উদ্যোগ : বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠন বলয় সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে কাজ করে চলেছে। অনুসন্ধিৎসু চক্র কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনে বলয়গ্রহণ পর্যবেক্ষণ ক্যাম্প খুলছে। এ সংক্রান্ত ঘোষণা দিয়ে পোস্টারও বের করেছে। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ডিসকাশন প্রজেক্ট, মাসিক উন্মাদ, নেচার স্টাডি অ্যান্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন এবং কসমিক কালচার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে পর্যবেক্ষণের জন্য উৎসাহিত করছে এবং কক্সবাজারে পর্যবেক্ষণে যাচ্ছে। তবে সেন্টমার্টিনে পর্যবেক্ষণ ক্যাম্প বসানোর উদ্যোগ স্থগিত করা হয়েছে। এক সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে সংগঠনগুলোকে ফোনে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো ও চাপাচাপি করছে এসব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য। তারা একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে। অথচ সব সংগঠন মিলে ৪০-৫০ জন লোকও হবে না, যারা সেন্টমার্টিনে যেত। যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক যাচ্ছে, অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে, তাতে পরিবেশ অধিদফতরের কোনো মাথা ব্যথা নেই। অথচ জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য চিঠি দিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। আবার কারও বেলায় নিশ্চুপ। দেশের বিশিষ্টজনরা 'এ পর্যবেক্ষণে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হবে' দাবিটি নাকচ করে দিয়েছেন। পরিবেশ অধিদফতরের এ প্রবণতাকে বিজ্ঞান সংগঠনগুলো অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছে।
সতর্কতা : খালি চোখে সূর্যের দিকে তাকানো চোখের জন্য ক্ষতিকর। গ্রহণের সময় আলোর তীব্রতা অনেক কম থাকায় মানুষের সতর্কতা একদম থাকে না। তাই চোখের নিরাপত্তার জন্য পিন হোল বক্স, টেলিস্কোপ প্রতিফলন, ১১/১২ গ্রেডের ওয়েল্ডিং গল্গাসের ফিল্টার, এক্সপোজড এক্স-রে ফিল্ম, সাদাকালো ফিল্ম ফিল্টার, পানিতে প্রতিফলন, মাইলার সোলার ফিল্টার ব্যবহার করা উচিত। গামলায় পানি নিয়ে তাতে সূর্যের প্রতিফলন ঘটিয়েও নিরাপদ সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ সম্ভব।
২০০৯ সালের ২২ জুলাই শতাব্দীর শেষ পূর্ণ সূর্যগ্রহণ মেঘাচ্ছন্নতার কারণে দেশের সব জায়গা থেকে দেখা না গেলেও আগামীকাল সূর্যের বলয়গ্রহণ উপকূল থেকে দেখা যাবে।
প্রস্তুত কক্সবাজার
ধারণা করা হচ্ছে কাল শুক্রবার কক্সবাজার এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপে অসংখ্য লোক সমাগম হবে বহুল প্রতীক্ষিত বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য। বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি।
কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের সব হোটেল, গেস্ট হাউস ইতিমধ্যে অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। দ্বীপের বিলাসবহুল হোটেল বল্গু-মেরিনের ব্যবস্থাপক আবু তাহের জানালেন, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবারের জন্য তাদের হোটেলের সব কক্ষ ভাড়া হয়ে গেছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ জানালেন, সেন্টমার্টিনে বিপুল লোক সমাগম হতে যাচ্ছে বলয়গ্রাস প্রত্যক্ষ করার জন্য। এদিকে বেশি লোক সমাগমের কারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে।
অনুসন্ধিৎসু চক্র বিজ্ঞান ক্লাবের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি শাহজাহান মৃধা বেণু জানান, ২০০৯ সালের পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। বাংলাদেশের আকাশ থেকে ২১১৪ সালের আগে আর কোনো পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে না। এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে ১০৫ বছর। এর পরেরটি হবে ২৪৩৫ সালে। আংশিক গ্রাসের সূর্যগ্রহণ এত বিরল নয়, এ শতকেই বাংলাদেশের আকাশে সূর্যের ৩৭টি আংশিক গ্রাস দৃশ্যমান হবে।
বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণটি প্রত্যক্ষ করার জন্য কক্সবাজার সৈকত এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপে অনুসন্ধিৎসু চক্র বিজ্ঞান সংগঠন ও বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
Thursday, January 14, 2010
Labels:
news
Subscribe to:
Post Comments (Atom)

ki miss kortesi desher baire bole....deshe thakle ei birol scene r angsho hote partam
ReplyDelete